এই পেজে বা সাইটে কিছু খুঁজুন

ইউক্যারিওটিক কোশের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে বহুবিধ অত্যাবশ্যকীয় প্রক্রিয়া যা কোষকে সচল ও কার্যক্ষম রাখে। কোশ বিভাজন থেকে শুরু করে কোশীয় অঙ্গাণু ও অন্যান্য উপাদানের সুশৃঙ্খল চলাচল, এমনকি আমাদের পেশী সংকোচন পর্যন্ত—এই সমস্ত গতিশীল কাজের মূলে রয়েছে কিছু বিশেষ প্রোটিনের সমন্বিত কার্যক্রম। এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান এবং অপরিহার্য হলো মায়োসিন (Myosin)। মায়োসিন এক ধরণের মটর প্রোটিন (Motor Protein) যা কোশের সাইটোস্কেলিটনের অন্যতম উপাদান অ্যাক্টিন (Actin) ফিলামেন্টের উপর দিয়ে চলাচল করতে পারে। এই চলাচল সম্ভব হয় অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট (ATP) অণু থেকে প্রাপ্ত রাসায়নিক শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে। জীবন্ত সিস্টেমে মায়োসিন এর এই ATP-নির্ভর গতিশীলতাই কোষীয় কার্যকারিতার এক মূল ভিত্তি তৈরি করে। এই বিস্তারিত আলোচনায় আমরা মায়োসিন প্রোটিনের জটিল গঠন, এর বিভিন্ন প্রজাতি বা প্রকারভেদ এবং জীবন্ত কোষে এর বহুমুখী ভূমিকা, বিশেষ করে পেশী সংকোচনের মূল প্রক্রিয়া ক্রস-ব্রিজ সাইকেল (Cross-Bridge Cycle) নিয়ে গভীরভাবে আলোকপাত করবো।
মায়োসিনের মৌলিক গঠন এবং কার্যক্ষম ডোমেইন
মায়োসিন প্রোটিনের কার্যকারিতা বোঝার জন্য এর ত্রিমাত্রিক গঠন সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। বেশিরভাগ মায়োসিন প্রোটিন ভারী চেইন (Heavy Chain) এবং হালকা চেইন (Light Chain) নামক পলিপেপটাইড শৃঙ্খল দ্বারা গঠিত। এই চেইনগুলো একত্রিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সজ্জিত হয়ে কার্যকরী মায়োসিন অণুটি তৈরি করে। গঠন ও কাজের সুবিধার জন্য মায়োসিন এর প্রধান অংশগুলিকে তিনটি কার্যকরী ডোমেইনে ভাগ করা হয়:
- হেড ডোমেইন (Head Domain): এটি মায়োসিন এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সক্রিয় অংশ, যেখানে এর মূল কার্যকলাপ সংঘটিত হয়। হেড ডোমেইন দুটি প্রধান কার্যকরী স্থান থাকে:
- অ্যাক্টিন বাইন্ডিং সাইট (Actin Binding Site): এই স্থানটির মাধ্যমেই মায়োসিন হেড অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের সাথে যুক্ত হয়। অ্যাক্টিন এর সাথে সঠিক ও সুনির্দিষ্ট বন্ধন তৈরি করা মায়োসিন এর চলাচলের জন্য অপরিহার্য।
- ATP বাইন্ডিং সাইট (ATP Binding Site): এই স্থানে ATP অণু এসে যুক্ত হয়। ATP এর বন্ধন, হাইড্রোলাইসিস এবং উৎপাদ (ADP ও Pi) গুলির মুক্তি মায়োসিন হেড এর গঠনগত পরিবর্তন ঘটায়, যা অ্যাক্টিন এর উপর এর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। হেড ডোমেইনই সেই স্থান যেখানে ATP হাইড্রোলাইসিস ঘটে এবং রাসায়নিক শক্তি গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এটি একটি ATPase এনজাইম হিসেবে কাজ করে।
সংক্ষেপে, হেড ডোমেইন হলো মায়োসিন এর চালিকাশক্তি যা অ্যাক্টিন এর সাথে মিথস্ক্রিয়া করে এবং শক্তি উৎপন্ন ও ব্যবহার করে গতি তৈরি করে।
- নেক ডোমেইন (Neck Domain): হেড ডোমেইন এর ঠিক পরেই নেক ডোমেইন অবস্থিত। এটি তুলনামূলকভাবে অনমনীয় একটি অংশ এবং এখানে সাধারণত হালকা চেইনগুলি (Light Chain) (যেমন Essential Light Chain বা ELC এবং Regulatory Light Chain বা RLC) যুক্ত থাকে। এই হালকা চেইনগুলি নেকের দৃঢ়তা বাড়ায় এবং হেড ডোমেইন এর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। নেক ডোমেইনটি একটি লিভার আর্ম (Lever Arm) হিসেবে কাজ করে। ATP হাইড্রোলাইসিস থেকে প্রাপ্ত শক্তি যখন হেড ডোমেইন এ গঠনগত পরিবর্তন আনে, তখন এই লিভার আর্মটি অ্যাক্টিন এর উপর লাগানো হেডের বলকে কার্যকরভাবে একটি সরণে রূপান্তরিত করে, অনেকটা হাতলের মতো। নেকের দৈর্ঘ্য পাওয়ার স্ট্রোক (Power Stroke) এর সময় সরণের পরিমাণকে প্রভাবিত করে।
- টেইল ডোমেইন (Tail Domain): টেইল ডোমেইন হলো মায়োসিন এর পেছনের দিকের লম্বা অংশ যা নেক ডোমেইন এর সাথে যুক্ত থাকে। মায়োসিন এর বিভিন্ন প্রজাতি বা আইসোফর্মের (Isoform) মধ্যে টেইল ডোমেইন এর গঠন সর্বাধিক ভিন্নতা প্রদর্শন করে। এই টেইল ডোমেইন এর নির্দিষ্ট গঠনই নির্ধারণ করে যে মায়োসিন কোষের ভেতরে কী কাজ করবে এবং কোষের অন্যান্য উপাদান, যেমন অন্য মায়োসিন অণু, কোষীয় অঙ্গাণু, বা কোষপর্দার সাথে কীভাবে যুক্ত হবে।
- কিছু মায়োসিন এর (যেমন Myosin II) টেইল ডোমেইনগুলি একত্রিত হয়ে লম্বা ফিলামেন্ট তৈরি করতে পারে। এই ফিলামেন্ট গঠন পেশী সংকোচন বা সাইটোকাইনেসিস (Cytokinesis) এর মতো সম্মিলিত কাজের জন্য অপরিহার্য।
- অন্যান্য মায়োসিন এর (যেমন Myosin V) টেইল ডোমেইনগুলি নির্দিষ্ট কার্গো (যেমন অঙ্গাণু বা ভেসিকল) অথবা কোষের নির্দিষ্ট কাঠামোর সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য বিশেষায়িত বাইন্ডিং সাইট ধারণ করে।
সুতরাং, হেড হলো কার্যকলাপের কেন্দ্র, নেক হলো সেই কার্যকলাপকে গতিতে রূপান্তরিত করার লিভার এবং টেইল হলো সেই অংশ যা মায়োসিন কে তার নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত রাখে এবং তার বহন করা জিনিস নির্ধারণ করে।
মায়োসিন পরিবারের বৈচিত্র্য: ক্লাসিক্যাল এবং আনকনভেনশনাল মায়োসিন
মানুষ সহ ইউক্যারিওটিক জীবে মায়োসিন শুধুমাত্র একটি রূপে বিদ্যমান নয়, বরং একটি বৃহৎ এবং বিচিত্র পরিবারের সদস্য হিসেবে রয়েছে। এদের গঠন, চলার ধরণ এবং কার্যাবলীর উপর ভিত্তি করে মায়োসিন পরিবারকে প্রধানত দুটি বৃহৎ গ্রুপে ভাগ করা হয়: ক্লাসিক্যাল মায়োসিন (Classical Myosins) এবং আনকনভেনশনাল মায়োসিন (Unconventional Myosins)।
ক্লাসিক্যাল মায়োসিন: টাইপ II মায়োসিন (Myosin II)
টাইপ II মায়োসিন হলো মায়োসিন পরিবারের সবচেয়ে পরিচিত এবং বহুল আলোচিত সদস্য। এটি প্রধানত পেশী কোশে (Muscle Cells) প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, যেখানে এটি পেশী সংকোচনের মূল কাজটি করে। তবে প্রায় সকল ইউক্যারিওটিক কোষেও এটি অল্প পরিমাণে উপস্থিত থাকে এবং কোষ বিভাজনের শেষ দশায় (সাইটোকাইনেসিস) কোষের বিভাজনে ভূমিকা পালন করে।
- গঠন: টাইপ II মায়োসিন একটি ডাইমার (Dimer), অর্থাৎ এটি দুটি ভারী চেইন দ্বারা গঠিত। প্রতিটি ভারী চেইন এর একটি করে হেড এবং একটি লম্বা টেইল থাকে। এই টেইল অংশগুলি একে অপরের সাথে সর্পিলাকারে পেঁচিয়ে একটি কয়েল্ড-কয়েল (Coiled-Coil) গঠন তৈরি করে। নেক ডোমেইন এ হালকা চেইনগুলো যুক্ত থাকে।
- ফিলামেন্ট গঠন: একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো টাইপ II মায়োসিন এর টেইল ডোমেইন একত্রিত হয়ে সুশৃঙ্খল ও বৃহৎ মায়োসিন ফিলামেন্ট (Myosin Filament) তৈরি করতে পারে, যা পেশী কোষে মোটা ফিলামেন্ট (Thick Filament) নামে পরিচিত। এই মোটা ফিলামেন্টগুলি অ্যাক্টিন দ্বারা গঠিত পাতলা ফিলামেন্টের (Thin Filament) মাঝে অবস্থান করে।
- কার্যকারিতা: টাইপ II মায়োসিন এর মূল কাজ হলো অ্যাক্টিন ফিলামেন্টকে মোটা ফিলামেন্টের কেন্দ্রের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া। পাতলা এবং মোটা ফিলামেন্টের এই আপেক্ষিক সরণের মাধ্যমেই পেশী সংকোচন ঘটে, যা স্লাইডিং ফিলামেন্ট মডেল (Sliding Filament Model) দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়। টাইপ II মায়োসিন সাধারণত অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের নেগেটিভ প্রান্তের দিকে চলাচল করে।
আনকনভেনশনাল মায়োসিন (Unconventional Myosins):
ক্লাসিক্যাল টাইপ II মায়োসিন ব্যতীত মায়োসিন পরিবারের অন্যান্য সমস্ত সদস্যকে আনকনভেনশনাল মায়োসিন বলা হয়। এদের গঠন ও কার্যকারিতা টাইপ II এর চেয়ে ভিন্ন। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এরা সাধারণত ফিলামেন্ট তৈরি করে না এবং এদের টেইল ডোমেইন বিভিন্ন ধরণের কার্গো (কোষীয় উপাদান) বা কোষীয় কাঠামোর সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য বিশেষায়িত। কিছু উল্লেখযোগ্য আনকনভেনশনাল মায়োসিন এর উদাহরণ হলো:
- টাইপ I মায়োসিন (Myosin I): এরা সাধারণত মনোমার (Monomer), অর্থাৎ একটি মাত্র ভারী চেইন দ্বারা গঠিত। এদের টেইল ডোমেইন প্রায়শই কোষপর্দার সাথে যুক্ত থাকে এবং এরা এন্ডোসাইটোসিস (Endocytosis), অ্যাক্টিন সাইটোস্কেলিটনের বিন্যাস এবং কোষপর্দার টান নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
- টাইপ V মায়োসিন (Myosin V): এটি একটি ডাইমার (Dimer) তবে এর টেইল টাইপ II এর চেয়ে ভিন্ন এবং এটি কার্গো বাইন্ডিং ডোমেইন ধারণ করে। টাইপ V মায়োসিন কোষের ভেতরে অঙ্গাণু (যেমন মাইটোকন্ড্রিয়া, গলগি অ্যাপারেটাস থেকে উৎপন্ন ভেসিকল) এবং অন্যান্য বৃহৎ অণু (mRNA) পরিবহনে মূল ভূমিকা পালন করে। এদের চলার ধরণ অনেকটা "ধাপ ফেলে হাঁটার" (Processive or Hand-over-Hand Walking) মতো, যার ফলে এরা অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের উপর দিয়ে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।
- টাইপ VI মায়োসিন (Myosin VI): এটি একমাত্র মায়োসিন যা অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের উপর দিয়ে সাধারণত অন্যান্য মায়োসিন এর বিপরীত দিকে (পজিটিভ প্রান্তের দিকে) চলাচল করে। এটি এন্ডোসাইটোসিস, গলগি অ্যাপারেটাস থেকে ভেসিকল পরিবহনে এবং কোষের নির্দিষ্ট সংযুক্তি (Adherence) নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও মায়োসিন এর আরও অনেক ভাগ (যেমন Myosin VII, X, XV ইত্যাদি) আবিষ্কৃত হয়েছে, যাদের প্রত্যেকের নিজস্ব নির্দিষ্ট কোষীয় কার্যাবলী রয়েছে, যেমন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং ভারসাম্য রক্ষা, কোষের মেরুকরণ (Cell Polarization) ইত্যাদি। মায়োসিন পরিবারের এই বিশাল বৈচিত্র্য জীবন্ত কোষের জটিল কার্যকারিতার জন্য এর অপরিহার্যতাকে প্রমাণ করে।
পেশী সংকোচনের আণবিক প্রক্রিয়া: ক্রস-ব্রিজ সাইকেল
পেশী সংকোচনের মূল চালিকাশক্তি হলো অ্যাক্টিন এবং টাইপ II মায়োসিন ফিলামেন্টের মধ্যে ঘটে চলা চক্রাকার মিথস্ক্রিয়া, যা ক্রস-ব্রিজ সাইকেল (Cross-Bridge Cycle) নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়াটি ATP অণু থেকে প্রাপ্ত শক্তি ব্যবহার করে সম্পন্ন হয়। প্রতিটি চক্রে, একটি মায়োসিন হেড অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের সাথে যুক্ত হয়, ATP শক্তি ব্যবহার করে অ্যাক্টিন কে টেনে নেয় এবং তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে অ্যাক্টিন এর উপর একটি নতুন বাইন্ডিং সাইটের জন্য প্রস্তুত হয়। লক্ষ লক্ষ মায়োসিন হেড একই সময়ে কিন্তু স্বাধীনভাবে এই চক্রটি পুনরাবৃত্তি করার ফলেই পেশীর সংকোচন ঘটে। ক্রস-ব্রিজ সাইকেল এর ধাপগুলো নিচে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো:
- ATP সংযোগ এবং মায়োসিন এর অ্যাক্টিন থেকে বিচ্ছিন্নতা (ATP Binding and Dissociation): এই ধাপ থেকে চক্রের শুরু বা পূর্ববর্তী চক্রের সমাপ্তি। যখন একটি ATP (অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট) অণু মায়োসিন হেড এর নির্দিষ্ট ATP-বাইন্ডিং সাইট এ এসে যুক্ত হয়, তখন মায়োসিন হেড এর গঠনে একটি তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের ফলস্বরূপ অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের প্রতি মায়োসিন হেড এর আকর্ষণ অত্যন্ত হ্রাস পায়। এর ফলে, মায়োসিন হেড বিচ্ছিন্ন (Dissociate) হয়ে যায়। পেশী শিথিল হওয়ার জন্য এবং পরবর্তী সংকোচনের জন্য এই বিচ্ছিন্নতা অপরিহার্য। ATP-এর উপস্থিতি এই ধাপে মূল ভূমিকা পালন করে। ATP-এর অভাবে মায়োসিন অ্যাক্টিন এর সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত অবস্থায় আটকে থাকে, যা রিগর মর্টিসের কারণ।
- ATP হাইড্রোলাইসিস এবং মায়োসিন হেড এর ককিং (ATP Hydrolysis and Cocking): অ্যাক্টিন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর, মায়োসিন হেড তার সাথে যুক্ত ATP অণুকে ভেঙে ফেলে। এই প্রক্রিয়াকে হাইড্রোলাইসিস (Hydrolysis) বলা হয়, যেখানে ATP অণু ADP (অ্যাডেনোসিন ডাইফসফেট) এবং একটি অজৈব ফসফেট (Pi) এ রূপান্তরিত হয়। এই হাইড্রোলাইসিস প্রক্রিয়া থেকে যে শক্তি নির্গত হয়, তা মায়োসিন হেড এর মধ্যে জমা হয় এবং এর গঠন পরিবর্তন করে। হেডটি অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের সাপেক্ষে প্রায় ৯০° কোণে বেঁকে বা "ককড" (Cocked) অবস্থায় চলে আসে। এই অবস্থাটিকে উচ্চ-শক্তির কনফর্মেশন (High-Energy Conformation) বলা হয়, কারণ হাইড্রোলাইসিস থেকে প্রাপ্ত শক্তি এই অবস্থায় স্থিতিশক্তি হিসেবে সঞ্চিত থাকে, অনেকটা স্প্রিং চাপানোর মতো। এই পর্যায়ে ADP এবং Pi হেডের সাথেই যুক্ত থাকে।
- মায়োসিন হেড এর অ্যাক্টিন এর সাথে দুর্বল সংযোগ (Weak Binding): "ককড" বা উচ্চ-শক্তির অবস্থায় থাকা মায়োসিন হেডটি এখন অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের উপর একটি নতুন বাইন্ডিং সাইটের দিকে প্রসারিত হয় এবং তার সাথে একটি দুর্বল, অস্থায়ী বন্ধন তৈরি করে। এই বন্ধন তখনও শক্তিশালী হয় না যতক্ষণ না পরবর্তী ধাপে ফসফেট (Pi) মুক্তি পায়। পেশী শিথিল অবস্থায়, অ্যাক্টিন বাইন্ডিং সাইটগুলি ট্রোপোমায়োসিন (Tropomyosin) প্রোটিন দ্বারা আবৃত থাকে, যা মায়োসিন কে এই ধাপে অ্যাক্টিন এর সাথে যুক্ত হতে বাধা দেয়। পেশী সংকোচনের জন্য স্নায়বিক উদ্দীপনা এলে ক্যালসিয়াম আয়ন (Ca$^{2+}$) নিঃসৃত হয় এবং ট্রোপোনিন (Troponin) প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়ে ট্রোপোমায়োসিন কে সরিয়ে দেয়, যার ফলে অ্যাক্টিন বাইন্ডিং সাইটগুলি উন্মুক্ত হয় এবং মায়োসিন যুক্ত হতে পারে।
- ফসফেট মুক্তি এবং শক্তিশালী বন্ধন গঠন (Pi Release and Strong Binding): অ্যাক্টিন এর সাথে সংযুক্ত হওয়ার পর, মায়োসিন হেড থেকে যুক্ত থাকা অজৈব ফসফেট (Pi) অণু মুক্তি পায়। ফসফেট মুক্তির ফলে মায়োসিন হেড এর গঠনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে, যা অ্যাক্টিন এর সাথে তার বন্ধনকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তোলে। এই শক্তিশালী বন্ধন গঠনই পাওয়ার স্ট্রোকের (Power Stroke) সূচনা করে। ফসফেট মুক্তি একটি ট্রিগার হিসেবে কাজ করে যা মায়োসিন হেড কে তার উচ্চ-শক্তির "ককড" অবস্থা থেকে নিম্ন-শক্তির কনফর্মেশন (Low-Energy Conformation) বা তার মূল অবস্থায় ফিরে যেতে বাধ্য করে।
- ADP মুক্তি এবং পাওয়ার স্ট্রোক সম্পন্ন হওয়া (ADP Release and Power Stroke Completion): ফসফেট মুক্তির পরপরই মায়োসিন হেড থেকে ADP অণুও মুক্তি পায়। ADP মুক্তির সাথে সাথে মায়োসিন হেড এর গঠনগত পরিবর্তন সম্পন্ন হয় এবং হেডটি তার মূল অবস্থানে ফিরে আসে। এই গঠনগত পরিবর্তনের সময় মায়োসিন হেডটি অ্যাক্টিন ফিলামেন্টটিকে মায়োসিন ফিলামেন্টের কেন্দ্রের দিকে প্রায় ১০-১৫ ন্যানোমিটার দূরত্বে টেনে নিয়ে আসে। অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের এই সরণই হলো মূল পাওয়ার স্ট্রোক (Power Stroke)। এটিই পেশী সংকোচনের জন্য প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক বল প্রয়োগ করে। পাওয়ার স্ট্রোক সম্পন্ন হওয়ার পর, মায়োসিন হেড অ্যাক্টিন এর সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত অবস্থায় থাকে, যা রিগর স্টেট (Rigor State) নামে পরিচিত।
- ATP সংযোগ (প্রথম ধাপে ফিরে যাওয়া) (ATP Binding - Return to Step 1): পাওয়ার স্ট্রোক সম্পন্ন হওয়ার পর এবং ADP মুক্তি পাওয়ার পর, মায়োসিন হেড অ্যাক্টিন এর সাথে একটি অত্যন্ত দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। কোষের ভেতরে যদি পর্যাপ্ত ATP উপলব্ধ থাকে, তবে নতুন একটি ATP অণু দ্রুত এসে মায়োসিন হেড এর ATP-বাইন্ডিং সাইট এ যুক্ত হয়। এই ATP এর সংযোগ মায়োসিন হেড এর অ্যাক্টিন এর প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে দেয় এবং এটিকে অ্যাক্টিন ফিলামেন্ট থেকে পুনরায় বিচ্ছিন্ন (Dissociate) করে দেয়, ঠিক প্রথম ধাপের মতো। একবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, মায়োসিন হেড আবার নতুন ATP হাইড্রোলাইজ করে "ককড" অবস্থায় ফিরে যেতে প্রস্তুত হয় এবং আরেকটি ক্রস-ব্রিজ সাইকেল শুরু করে (ধাপ ২)। এইভাবে, যতক্ষণ ATP এবং প্রয়োজনীয় সংকেত (ক্যালসিয়াম) উপস্থিত থাকে, এই চক্রটি দ্রুতগতিতে বারবার চলতে থাকে, যার ফলে অ্যাক্টিন ফিলামেন্টগুলো মায়োসিন ফিলামেন্টের উপর স্লাইড করতে থাকে এবং পেশীর সংকোচন অব্যাহত থাকে।
এই ধারাবাহিক চক্রাকার প্রক্রিয়ার ফলেই পেশীর তন্তুগুলো ছোট হয় এবং পেশীর সংকোচন ঘটে। প্রতিটি মায়োসিন হেড এর ছোট ছোট সরণ একত্রিত হয়ে পেশীর সামগ্রিক এবং শক্তিশালী সংকোচন সম্ভব করে তোলে।
অন্যান্য কোষীয় কার্যাবলীতে আনকনভেনশনাল মায়োসিন এর ভূমিকা
পেশী সংকোচন ছাড়াও, আনকনভেনশনাল মায়োসিন প্রোটিনগুলো কোষের অভ্যন্তরে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের কাজ কোষের গঠন, গতিশীলতা, এবং বিভিন্ন উপাদানের পরিবহনের জন্য অপরিহার্য:
- কোষ বিভাজন (Cell Division): ইউক্যারিওটিক কোষে সাইটোকাইনেসিস (Cytokinesis), অর্থাৎ কোষ বিভাজনের শেষ পর্যায়ে কোষপর্দার সংকোচন ঘটিয়ে কোষকে দুটি অপত্য কোষে বিভক্ত করার প্রক্রিয়ায় টাইপ II মায়োসিন অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের সাথে মিলিত হয়ে একটি সংকোচনশীল বলয় (Contractile Ring) গঠন করে।
- কোষীয় উপাদান ও অঙ্গাণু পরিবহন (Organelle and Cellular Component Transport): টাইপ V মায়োসিন কোষের অভ্যন্তরে অঙ্গাণু (যেমন মাইটোকন্ড্রিয়া, গলগি অ্যাপারেটাস থেকে উৎপন্ন ভেসিকল) এবং অন্যান্য বৃহৎ অণু (mRNA) পরিবহনে মূল ভূমিকা পালন করে। এরা অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের 'রাস্তা' ব্যবহার করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে এই 'কার্গো' গুলিকে পৌঁছে দেয়। এদের অ্যাক্টিন এর উপর দিয়ে দীর্ঘ পথ ধরে হেঁটে যাওয়ার ক্ষমতা (Processivity) এই পরিবহনকে অত্যন্ত কার্যকরী করে তোলে। অন্যান্য মায়োসিন ও ভেসিকল পরিবহনে জড়িত।
- কোষের আকৃতি, মেরুকরণ এবং চলন (Cell Shape, Polarity, and Motility): বিভিন্ন আনকনভেনশনাল মায়োসিন, যেমন টাইপ I, VII, X, ইত্যাদি, অ্যাক্টিন সাইটোস্কেলিটনের গঠন ও পুনর্গঠন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এরা কোষের আকৃতি পরিবর্তন, কোষপর্দার অভিক্ষেপ বা প্রোট্রুশন (Protrusion) গঠন (যেমন ল্যামেলিপোডিয়া বা ফিলোপোডিয়া তৈরি), এবং কোষের সামগ্রিক চলন (যেমন রোগ প্রতিরোধক কোষের জীবাণুর দিকে ধাবিত হওয়া) সক্ষম করে। এছাড়াও, এরা কোষের মেরুকরণ (Cell Polarization) অর্থাৎ কোষের বিভিন্ন অংশে কাজের ভিন্নতা স্থাপন ও বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- এন্ডোসাইটোসিস এবং এক্সোসাইটোসিস (Endocytosis and Exocytosis): কোষপর্দা থেকে ভেসিকল তৈরির প্রক্রিয়া (এন্ডোসাইটোসিস) এবং ভেসিকলগুলি কোষপর্দার সাথে ফিউজ করে ভেতরের উপাদান বাইরে নিঃসরণের প্রক্রিয়া (এক্সোসাইটোসিস)-এ কিছু নির্দিষ্ট আনকনভেনশনাল মায়োসিন জড়িত থাকে। বিশেষ করে টাইপ I এবং টাইপ VI মায়োসিন এই প্রক্রিয়াগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সংবেদী অঙ্গের কার্যকারিতা (Sensory Organ Function): শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং ভারসাম্য রক্ষার মতো সংবেদী কার্যাবলীতে কিছু বিশেষ আনকনভেনশনাল মায়োসিন এর ভূমিকা অপরিহার্য। কানের ভেতরের চুলের কোষে (Hair Cells) উপস্থিত মাইওসিন VIIA (MYO7A) শব্দ তরঙ্গের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা এবং সংকেত প্রেরণে গুরুত্বপূর্ণ। রেটিনার ফটোরিসেপ্টর কোষেও মায়োসিন এর উপস্থিতি সংকেত প্রক্রিয়াকরণে জড়িত।
এই বিভিন্ন কার্যাবলী থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মায়োসিন প্রোটিন জীবন্ত কোষের গতিশীলতার এক বিশাল এবং অত্যাবশ্যকীয় নেটওয়ার্কের অংশ, যা শুধুমাত্র পেশী সংকোচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
মায়োসিনের ক্লিনিক্যাল গুরুত্ব এবং রোগ
মায়োসিন প্রোটিনের গঠন এবং কার্যকারিতায় যেকোনো ধরণের ত্রুটি মানবদেহে বিভিন্ন গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে। মায়োসিন এনকোডিং জিনগুলিতে জেনেটিক মিউটেশন বা ত্রুটির ফলে সৃষ্ট কিছু উল্লেখযোগ্য রোগ এবং সিনড্রোম নিচে উল্লেখ করা হলো:
- পেশী রোগ (Myopathies): মায়োসিন II সহ বিভিন্ন মায়োসিন জিনের মিউটেশন জন্মগত মায়োপ্যাথি, নেমালাইন মায়োপ্যাথি এবং অন্যান্য ধরণের পেশীর দুর্বলতা, কার্যকারিতা হ্রাস বা অস্বাভাবিক কাঠামোর মতো রোগের কারণ হতে পারে।
- কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Cardiomyopathies): হৃদপিণ্ডের পেশীর প্রধান সংকোচক প্রোট হওয়ায়, বিটা-মায়োসিন ভারী চেইনের (β-Myosin Heavy Chain, MYH7) মতো জিনের মিউটেশন হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Hypertrophic Cardiomyopathy), যেখানে হৃদপেশীর অস্বাভাবিক পুরুত্ব ঘটে, এবং ডাইলেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Dilated Cardiomyopathy), যেখানে হৃদপিণ্ডের প্রকোষ্ঠগুলি প্রসারিত হয়ে যায়, এর মতো মারাত্মক হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
- শ্রবণশক্তি হ্রাস ও বধিরতা (Hearing Loss and Deafness): কানের ভেতরের চুলের কোষে (Hair Cells) উপস্থিত মাইওসিন VIIA (MYO7A) এবং অন্যান্য মায়োসিন এর মিউটেশন জন্মগত এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা বধিরতার কারণ হতে পারে। এটি আশার সিনড্রোম (Usher Syndrome)-এর মতো সিনড্রোমের সাথেও জড়িত, যেখানে বধিরতার সাথে দৃষ্টিশক্তির সমস্যাও থাকে।
- কিডনি রোগ (Kidney Diseases): কিছু নির্দিষ্ট মায়োসিন কিডনি কোষেও পাওয়া যায় এবং এদের কার্যকারিতা ত্রুটি নেফ্রোটিক সিনড্রোম (Nephrotic Syndrome)-এর মতো কিডনি রোগের কারণ হতে পারে।
- অন্যান্য সিনড্রোম: বিভিন্ন আনকনভেনশনাল মায়োসিন জিনের মিউটেশন আলপোর্ট সিনড্রোম (Alport Syndrome) (কিডনি রোগ, শ্রবণশক্তি হ্রাস ও বধিরতা ও চোখের সমস্যা) এবং গ্রিসেলি সিনড্রোম (Griscelli Syndrome) (অ্যালবিনিজম এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি) এর মতো বিরল ও জটিল সিনড্রোমের সাথে সম্পর্কিত।
এভাবে দেখা যায়, মায়োসিন প্রোটিনের সঠিক কার্যকারিতা জীবন্ত কোষ এবং সমগ্র জীবের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। মায়োসিন সম্পর্কিত রোগগুলির আণবিক ভিত্তি বোঝা রোগ নির্ণয়, প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি (যেমন টার্গেটেড থেরাপি বা জিন থেরাপি) বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
উপসংহার
সার্বিকভাবে, মায়োসিন প্রোটিন হলো ইউক্যারিওটিক জীবের গতিশীলতা এবং যান্ত্রিক কার্যকারিতার এক অসাধারণ এবং অপরিহার্য উপাদান। পেশী সংকোচনের শক্তিশালী কার্যকলাপ থেকে শুরু করে কোষের অভ্যন্তরে অতি সূক্ষ্ম অঙ্গাণু পরিবহন, কোষ বিভাজন এবং কোষের আকৃতি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত—সর্বত্রই মায়োসিন এর অবদান অনস্বীকার্য। ATP থেকে শক্তি গ্রহণ করে অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের উপর দিয়ে এর সুনির্দিষ্ট চলাচল ইউক্যারিওটিক কোষের অসংখ্য প্রক্রিয়ার ভিত্তি তৈরি করে। টাইপ II মায়োসিন এর ক্রস-ব্রিজ সাইকেল পেশী সংকোচনের আণবিক প্রক্রিয়াটিকে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করে দেখায় কিভাবে রাসায়নিক শক্তি যান্ত্রিক কাজে রূপান্তরিত হয়। আনকনভেনশনাল মায়োসিনগুলি কোষের ভেতরে বিভিন্ন কার্গো পরিবহন এবং সাইটোস্কেলিটনের গতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মায়োসিন প্রোটিনের গঠন, বিভিন্ন প্রকারভেদ এবং কোষীয় কার্যকারিতা সম্পর্কে আমাদের ক্রমবর্ধমান জ্ঞান জীববিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। ভবিষ্যৎ গবেষণায় মায়োসিন সম্পর্কিত রোগগুলির আরও উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি এবং কোষীয় গতির নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আরও গভীর রহস্য উন্মোচিত হবে বলে আশা করা যায়।
Last Updated: April 25, 2025