আমাদের চারপাশের প্রকৃতি সবুজের এক বিশাল ক্যানভাস। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এই সবুজ কিন্তু একঘেয়ে নয়। আম গাছের পাতার গাঢ় সবুজের পাশে কলা গাছের কলাপাতা রঙের হালকা সবুজ, আবার ধানক্ষেতের বুকে এক ধরনের টিয়া সবুজ। কখনো কি মনে প্রশ্ন জেগেছে, কেন প্রকৃতির এই সবুজ রঙে এত বৈচিত্র্য? কেন সব গাছের পাতা একইরকম সবুজ হয় না? এই fascinating প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে পাতার গঠন, তার ভেতরে থাকা রাসায়নিক পদার্থ এবং পরিবেশের সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্যে। চলুন, এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করা যাক এবং ধাপে ধাপে জেনে নেওয়া যাক পাতার সবুজ রঙের শেডের পেছনের বিজ্ঞান।

১. সবুজের মূল কারিগর: ক্লোরোফিল
গাছের পাতার সবুজ রঙের জন্য দায়ী প্রধান রাসায়নিক পদার্থটির নাম হলো ক্লোরোফিল (Chlorophyll)। বাংলায় একে 'পত্রহরিৎ' বলা হয়। এটি উদ্ভিদের কোষের মধ্যে থাকা ক্লোরোপ্লাস্ট নামক একটি অংশে পাওয়া যায়। ক্লোরোফিলের প্রধান কাজ হলো সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) প্রক্রিয়ায় সাহায্য করা। এই প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ সূর্যের আলোর শক্তি ব্যবহার করে জল এবং কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে নিজের খাদ্য (শর্করা) তৈরি করে।
সূর্যের আলো, যা আমরা সাদা দেখি, তা আসলে সাতটি ভিন্ন রঙের (বেনীআসহকলা) আলোর মিশ্রণ। ক্লোরোফিল অণু এই আলোর বর্ণালী থেকে মূলত নীল এবং লাল রঙের আলো শোষণ করে নেয়। কিন্তু এটি সবুজ রঙের আলোকে শোষণ করতে পারে না, বরং প্রতিফলিত করে দেয়। এই প্রতিফলিত সবুজ আলো যখন আমাদের চোখে এসে পড়ে, তখনই আমরা পাতাকে সবুজ দেখি। এটিই হলো পাতার সবুজ হওয়ার মূল এবং প্রাথমিক কারণ।
২. ক্লোরোফিলের প্রকারভেদ: সবুজ রঙের শেডের কারণ
এখন প্রশ্ন হলো, যদি ক্লোরোফিলই সবুজ রঙের কারণ হয়, তাহলে সব পাতা একইরকম সবুজ হয় না কেন? এর উত্তর হলো, ক্লোরোফিল মূলত এক ধরনের হয় না। উদ্ভিদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের ক্লোরোফিল থাকে, তবে দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো:
ক্লোরোফিল-এ (Chlorophyll-a): এটি একটি নীলচে-সবুজ (Bluish-green) রঙের রঞ্জক এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। অর্থাৎ, এটিই আলোক শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার মূল কাজটি করে।
ক্লোরোফিল-বি (Chlorophyll-b): এটি একটি হলদে-সবুজ (Yellowish-green) রঙের রঞ্জক। এটি সরাসরি সালোকসংশ্লেষণে অংশ নেয় না, বরং এটি একটি সহায়ক রঞ্জক হিসেবে কাজ করে। এটি আলোর বর্ণালীর সেই অংশগুলো শোষণ করে যা ক্লোরোফিল-এ পারে না এবং সেই শক্তি ক্লোরোফিল-এ-এর কাছে পাঠিয়ে দেয়।
কোনো গাছের পাতায় এই দুই ধরনের ক্লোরোফিলের অনুপাতই তার সবুজ রঙের শেড নির্ধারণ করে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জে দেখতে পাওয়া আম, জাম বা কাঁঠাল গাছের পাতা বেশ গাঢ় সবুজ হয়। এর কারণ হলো, এই পাতাগুলোতে ক্লোরোফিল-এ-এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। অন্যদিকে, ধান গাছ বা কলা গাছের পাতার রঙ কিছুটা হালকা বা কলাপাতা সবুজ হয়, কারণ সেগুলিতে ক্লোরোফিল-বি-এর অনুপাত বেশি। এই দুই ক্লোরোফিলের বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণের ফলেই আমরা সবুজ রঙের এত ভিন্ন ভিন্ন শেড দেখতে পাই।
৩. অন্যান্য রঞ্জক পদার্থের লুকোচুরি খেলা
ক্লোরোফিল ছাড়াও গাছের পাতায় আরও কিছু সহায়ক রঞ্জক পদার্থ (Accessory Pigments) থাকে, যা পাতার রঙের ওপর প্রভাব ফেলে।
ক্যারোটিনয়েডস (Carotenoids): এই রঞ্জক পদার্থগুলো হলুদ, কমলা বা লালচে রঙের হয় (যেমন গাজরের মধ্যে থাকা ক্যারোটিন)। মজার ব্যাপার হলো, এই ক্যারোটিনয়েডগুলো সারাবছরই পাতার মধ্যে উপস্থিত থাকে। কিন্তু ক্লোরোফিলের গাঢ় সবুজ রঙের তীব্রতার কারণে এদের অস্তিত্ব বোঝা যায় না। শরৎকালে, যেমন আমাদের এখানে শিউলি ফোটার সময়ে বা শীতের আগে, যখন দিন ছোট হতে থাকে এবং তাপমাত্রা কমে যায়, তখন অনেক গাছের ক্লোরোফিল উৎপাদন প্রক্রিয়া ধীর হয়ে আসে এবং পুরোনো ক্লোরোফিল ভেঙে যেতে শুরু করে। ঠিক তখনই, এতদিন ধরে লুকিয়ে থাকা ক্যারোটিনয়েডের হলুদ এবং কমলা রঙ প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের অশ্বত্থ, বট বা শিমুল গাছের পাতা ঝরে পড়ার আগে হলুদ হয়ে যাওয়াটা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
অ্যান্থোসায়ানিন (Anthocyanins): এই রঞ্জক পদার্থগুলো লাল, বেগুনি বা নীল রঙের জন্য দায়ী। ক্যারোটিনয়েডের মতো এরা সবসময় পাতায় উপস্থিত থাকে না। নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে, যেমন তীব্র সূর্যালোক, ঠাণ্ডা আবহাওয়া বা পাতায় শর্করার পরিমাণ বেড়ে গেলে, গাছ এই রঞ্জক তৈরি করে। এটি অনেকটা গাছের সানস্ক্রিনের মতো কাজ করে, যা কচি পাতাকে অতিরিক্ত সূর্যালোকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচায়। আম গাছের নতুন কচি পাতা বা "আমের মুকুল" যে লালচে-তাজা রঙের হয়, তার পেছনে এই অ্যান্থোসায়ানিনের উপস্থিতিই কারণ। এছাড়াও, অনেক বাহারি গাছ যেমন ক্রোটন বা লালশাকের পাতার আকর্ষণীয় রঙের কারণও এই অ্যান্থোসায়ানিন।
সুতরাং, একটি পাতার চূড়ান্ত রঙ শুধুমাত্র ক্লোরোফিলের ওপর নির্ভর করে না, বরং ক্লোরোফিল, ক্যারোটিনয়েড এবং অ্যান্থোসায়ানিনের সম্মিলিত উপস্থিতি এবং পরিমাণের ওপর নির্ভর করে।
৪. পাতার বয়স এবং স্বাস্থ্য
মানুষের মতোই, গাছের পাতার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তার রঙ বদলায়।
কচি পাতা: একেবারে নতুন গজানো পাতাগুলো হালকা সবুজ বা অনেক সময় লালচে হয়। কারণ, তখনো পাতায় ক্লোরোফিল পুরোপুরি তৈরি হয়নি এবং অ্যান্থোসায়ানিন তাকে রোদ থেকে সুরক্ষা দেয়।
পরিণত পাতা: একটি সুস্থ ও পরিণত পাতা হলো গাছের রান্নাঘর। তাই খাদ্য তৈরির জন্য এতে ক্লোরোফিল কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। একারণে এর রঙ হয় সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং গাঢ় সবুজ। যেমন, বর্ষাকালে একটি সুস্থ পেয়ারা গাছের পাতার টকটকে সবুজ রঙ।
বয়স্ক পাতা: বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাতার কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং ক্লোরোফিল ভেঙে যেতে শুরু করে। ফলে ক্যারোটিনয়েডের হলুদ রঙ প্রকাশ পায় এবং পাতাটি হলুদ বা বাদামী হয়ে ঝরে পড়ে।
৫. পরিবেশ এবং ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাব
গাছ কোথায় এবং কোন পরিবেশে বেড়ে উঠছে, তার ওপরও পাতার রঙ অনেকাংশে নির্ভর করে।
সূর্যালোক: পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণের জেলাগুলিতে, যেখানে রোদ সরাসরি এবং তীব্র, সেখানকার গাছপালা নিজেদের রক্ষা করার জন্য বেশি পরিমাণে ক্লোরোফিল তৈরি করে। তাই এদের পাতা বেশি গাঢ় হয়। আবার, উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং-এর পাহাড়ে বা ডুয়ার্সের জঙ্গলে যেখানে বড় গাছের ছায়ায় অনেক ছোট গাছ জন্মায়, তাদের পাতা প্রায়শই বড় এবং হালকা সবুজ রঙের হয়। কারণ, কম আলোয় সালোকসংশ্লেষণ করার জন্য তাদের পাতার ক্ষেত্রফল বাড়াতে হয় এবং ক্লোরোফিল সেভাবে ছড়ানো থাকে।
মাটির পুষ্টি: ক্লোরোফিল অণু তৈরির জন্য নাইট্রোজেন এবং ম্যাগনেসিয়াম অত্যন্ত জরুরি দুটি উপাদান। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকেরা জমিতে ইউরিয়া সার দেন, যার মধ্যে নাইট্রোজেন থাকে। এই সার দেওয়ার পর ধান বা পাটের ক্ষেত আরও ঘন সবুজ হয়ে ওঠে। এর কারণ হলো, নাইট্রোজেন পেয়ে গাছ প্রচুর পরিমাণে ক্লোরোফিল তৈরি করতে পারে। মাটিতে এই উপাদানগুলোর অভাব হলে পাতা হলুদ হয়ে যায়, এই অবস্থাকে ক্লোরোসিস (Chlorosis) বলা হয়।
জল এবং তাপমাত্রা: পর্যাপ্ত জল এবং অনুকূল তাপমাত্রা গাছের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। গ্রীষ্মকালে পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার মতো শুষ্ক অঞ্চলে জলের অভাবে অনেক গাছের পাতা ফ্যাকাশে বা অনুজ্জ্বল হয়ে যায়। আবার বর্ষার জল পেয়ে সেই গাছই নতুন সতেজ ও গাঢ় সবুজ পাতায় ভরে ওঠে।
উপসংহার
শেষ পর্যন্ত, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে একটি গাছের পাতার সবুজ রঙের শেড কোনো একক কারণে নয়, বরং এটি একটি জটিল এবং সুসমন্বিত প্রক্রিয়ার ফল। ক্লোরোফিলের প্রকার ও অনুপাত, ক্যারোটিনয়েড ও অ্যান্থোসায়ানিনের মতো সহায়ক রঞ্জক, পাতার বয়স ও স্বাস্থ্য এবং গাছটির পারিপার্শ্বিক পরিবেশ—এই সবকিছু মিলেই তৈরি করে প্রকৃতির সবুজ রঙের এই বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় প্যালেট। পরেরবার যখন কোনো গাছের দিকে তাকাবেন, তখন শুধু তার সবুজ রঙটিই দেখবেন না, তার পেছনের এই অসাধারণ বিজ্ঞানটিকেও উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন।