পর্যায় সারণী - Complete Guide

পর্যায় সারণী

রসায়ন বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর হলো পর্যায় সারণী (Periodic Table)। এটি শুধু মৌলসমূহের একটি তালিকা নয়, বরং এটি মৌলের পারমাণবিক গঠন, ধর্ম এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের এক বিশাল তথ্যভান্ডার। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি চাকরির (SSC, WBCS, Railway, PSC) পরীক্ষার্থী—সকলের জন্য পর্যায় সারণীর একটি স্বচ্ছ এবং গভীর ধারণা থাকা অপরিহার্য। এই পোস্টে আমরা পর্যায় সারণীর প্রতিটি দিক খুঁটিনাটিসহ আলোচনা করব।

বাংলায় পর্যায় সারণী

চিত্র: আধুনিক পর্যায় সারণী


পর্যায় সারণীর বিবর্তন: ইতিহাসের পাতা থেকে

আজকের এই সুবিন্যস্ত পর্যায় সারণী একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বহু বিজ্ঞানীর অবদান।

  • ডোবেরাইনারের ত্রয়ী সূত্র (1829): তিনি সমধর্মী তিনটি মৌলকে পারমাণবিক ভর অনুযায়ী সাজিয়ে দেখেন, মাঝের মৌলটির ভর অন্য দুটির ভরের প্রায় গড় হয়। যেমন: (Li, Na, K)।
  • নিউল্যান্ডের অষ্টক সূত্র (1864): তিনি মৌলসমূহকে পারমাণবিক ভর অনুসারে সাজিয়ে দেখেন যে, প্রতি অষ্টম মৌলের ধর্ম প্রথম মৌলটির মতো হয়।
  • মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণী (1869): "পর্যায় সারণীর জনক" দিমিত্রি মেন্ডেলিফ পারমাণবিক ভরের ভিত্তিতে প্রথম সার্থক পর্যায় সারণী তৈরি করেন।
    • সাফল্য: তিনি মৌলগুলোকে ধর্মের ভিত্তিতে সাজান, কিছু অনাবিষ্কৃত মৌলের (যেমন: একা-অ্যালুমিনিয়াম → গ্যালিয়াম, একা-সিলিকন → জার্মেনিয়াম) জন্য ফাঁকা স্থান রাখেন এবং তাদের ধর্ম সম্পর্কে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
    • ত্রুটি: কিছু ক্ষেত্রে বেশি পারমাণবিক ভরের মৌলকে কম ভরের মৌলের আগে স্থান দিতে হয় (যেমন: Ar ও K)। আইসোটোপের কোনো স্থান ছিল না।
  • আধুনিক পর্যায় সূত্র (1913): বিজ্ঞানী হেনরি মোসলে প্রমাণ করেন যে, মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মাবলী পারমাণবিক ভরের ওপর নয়, বরং পারমাণবিক সংখ্যা (Atomic Number)-এর ওপর পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। এর ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক পর্যায় সারণী গঠিত।

আধুনিক পর্যায় সারণীর গঠন

আধুনিক পর্যায় সারণীতে ৭টি পর্যায় এবং ১৮টি গ্রুপ রয়েছে।

১. পর্যায় (Period)

  • ৭টি অনুভূমিক সারিকে পর্যায় বলে। পর্যায় সংখ্যা মৌলের সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরের সংখ্যা নির্দেশ করে।
  • প্রতিটি পর্যায়ে মৌলের সংখ্যা নির্দিষ্ট:
    • ১ম পর্যায়: ২ টি (H, He) - অতি হ্রস্ব পর্যায়
    • ২য় ও ৩য় পর্যায়: ৮ টি করে - হ্রস্ব পর্যায়
    • ৪র্থ ও ৫ম পর্যায়: ১৮ টি করে - দীর্ঘ পর্যায়
    • ৬ষ্ঠ ও ৭ম পর্যায়: ৩২ টি করে - অতি দীর্ঘ পর্যায়

২. গ্রুপ বা শ্রেণী (Group)

  • ১৮টি উল্লম্ব কলামকে গ্রুপ বলে। একই গ্রুপের মৌলদের সর্ববহিঃস্থ কক্ষে ইলেকট্রন সংখ্যা (যোজ্যতা ইলেকট্রন) সমান হওয়ায় এদের রাসায়নিক ধর্মে সাদৃশ্য দেখা যায়।

৩. ব্লক (Block)

ইলেকট্রন বিন্যাসে সর্বশেষ ইলেকট্রনটি কোন উপকক্ষে (orbital) প্রবেশ করে, তার ওপর ভিত্তি করে মৌলদের ৪টি ব্লকে ভাগ করা হয়:

  • s-ব্লক: গ্রুপ ১ ও ২। এরা নরম, তীব্র তড়িৎ ধনাত্মক ধাতু।
  • p-ব্লক: গ্রুপ ১৩ থেকে ১৮। এই ব্লকে ধাতু, অধাতু এবং ধাতুকল্প—সবই বর্তমান।
  • d-ব্লক: গ্রুপ ৩ থেকে ১২। এদের অবস্থান্তর মৌল (Transition Elements) বলে। এরা রঙিন যৌগ গঠন করে, পরিবর্তনশীল যোজ্যতা দেখায় এবং প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
  • f-ব্লক: পর্যায় সারণীর নিচে অবস্থিত দুটি সারি। এদের অন্তঃঅবস্থান্তর মৌল (Inner Transition Elements) বলে।
    • ল্যান্থানাইড সারি (Z=58-71): বিরল মৃত্তিকা মৌল (Rare Earth Metals)।
    • অ্যাকটিনাইড সারি (Z=90-103): এরা সকলেই তেজস্ক্রিয়।

মৌলদের বিশেষ পরিচিতি (পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ)

  • ক্ষার ধাতু (Alkali Metals): গ্রুপ ১ (H ছাড়া)।
  • মৃৎক্ষার ধাতু (Alkaline Earth Metals): গ্রুপ ২।
  • মুদ্রা ধাতু (Coinage Metals): গ্রুপ ১১ (Cu, Ag, Au)।
  • চ্যালকোজেন (Chalcogens): গ্রুপ ১৬ (O, S, Se)। অর্থ "আকরিক উৎপাদক"।
  • হ্যালোজেন (Halogens): গ্রুপ ১৭ (F, Cl, Br, I)। অর্থ "লবণ উৎপাদক"।
  • নিষ্ক্রিয় গ্যাস (Noble Gases): গ্রুপ ১৮ (He, Ne, Ar)। এদের যোজ্যতা শূন্য।
  • ধাতুকল্প বা অপধাতু (Metalloids): B, Si, Ge, As, Sb, Te। এরা অর্ধপরিবাহী (Semiconductor)।
  • ইউরেনিয়াম পরবর্তী মৌল (Transuranic Elements): পারমাণবিক সংখ্যা ৯২-এর বেশি মৌলগুলো কৃত্রিম ও তেজস্ক্রিয়।

পর্যায়বৃত্ত ধর্ম (Periodic Trends) এবং তাদের ব্যাখ্যা

পর্যায় সারণীতে বাম থেকে ডানে বা উপর থেকে নিচে মৌলের কিছু ধর্ম নিয়মিতভাবে পরিবর্তিত হয়।

ধর্ম পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গ্রুপে উপর থেকে নিচে
পারমাণবিক ব্যাসার্ধ হ্রাস পায় (নিউক্লীয় চার্জ বাড়ে) বৃদ্ধি পায় (নতুন কক্ষপথ যুক্ত হয়)
আয়নিকরণ শক্তি বৃদ্ধি পায় (আকার ছোট হয়) হ্রাস পায় (আকার বড় হয়)
ইলেকট্রন আসক্তি বৃদ্ধি পায় (নিউক্লীয় আকর্ষণ বাড়ে) হ্রাস পায় (আকার বড় হয়)
তড়িৎ ঋণাত্মকতা বৃদ্ধি পায় হ্রাস পায়
ধাতব ধর্ম হ্রাস পায় বৃদ্ধি পায়
অক্সাইডের আম্লিক ধর্ম বৃদ্ধি পায় (Na₂O ক্ষারীয় → SO₃ তীব্র আম্লিক) হ্রাস পায়

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ক্লোরিনের (Cl) ইলেকট্রন আসক্তি ফ্লোরিনের (F) চেয়ে বেশি। কারণ ফ্লোরিনের আকার অত্যন্ত ছোট হওয়ায় আগত ইলেকট্রনটি বিকর্ষণের সম্মুখীন হয়।


উচ্চতর ধারণা (Advanced Concepts for Competitive Exams)

১. তির্যক সম্পর্ক (Diagonal Relationship)

২য় পর্যায়ের কিছু মৌলের সাথে ৩য় পর্যায়ের পরবর্তী গ্রুপের মৌলের ধর্মের মিল দেখা যায়। একে তির্যক সম্পর্ক বলে। যেমন:

  • লিথিয়াম (Li) ও ম্যাগনেসিয়াম (Mg)
  • বেরিলিয়াম (Be) ও অ্যালুমিনিয়াম (Al)

২. নিষ্ক্রিয় জোড় প্রভাব (Inert Pair Effect)

ভারী p-ব্লক মৌলগুলোর (গ্রুপ ১৩-১৬) ক্ষেত্রে সর্ববহিঃস্থ s-উপকক্ষের ইলেকট্রন দুটি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নিতে চায় না। ফলে মৌলটি তার গ্রুপীয় যোজ্যতার চেয়ে ২ কম যোজ্যতা প্রদর্শন করে। যেমন, লেড (Pb) +4 এর চেয়ে +2 যোজ্যতায় বেশি স্থায়ী।

৩. ল্যান্থানাইড সংকোচন (Lanthanide Contraction)

ল্যান্থানাইড সারির মৌলগুলোতে ইলেকট্রন f-অরবিটালে প্রবেশ করায় নিউক্লীয় চার্জ বাড়লেও আকারের সংকোচন আশানুরূপ হয় না। এর ফলে ল্যান্থানাইডদের পরবর্তী মৌলগুলোর (যেমন, 5d সারি) পারমাণবিক ব্যাসার্ধ প্রায় 4d সারির মৌলদের সমান হয়ে যায়। (যেমন: Zr ও Hf-এর আকার প্রায় সমান)।


গ্রুপ মনে রাখার সহজ কৌশল (Mnemonic)

পর্যায় সারণীর গ্রুপগুলো মনে রাখা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। নিচে কিছু মজাদার এবং সহজ কৌশল দেওয়া হলো যা আপনাকে গ্রুপগুলো সহজে মনে রাখতে সাহায্য করবে।

s-ব্লক মৌল

➤ গ্রুপ ১: ক্ষার ধাতু (Alkali Metals)

  • মৌলসমূহ: H (হাইড্রোজেন), Li (লিথিয়াম), Na (সোডিয়াম), K (পটাশিয়াম), Rb (রুবিডিয়াম), Cs (সিজিয়াম), Fr (ফ্রান্সিয়াম)
  • কৌশল: হালি না কে রুবি সাজাবে ফ্রান্সে।

➤ গ্রুপ ২: মৃৎক্ষার ধাতু (Alkaline Earth Metals)

  • মৌলসমূহ: Be (বেরিলিয়াম), Mg (ম্যাগনেসিয়াম), Ca (ক্যালসিয়াম), Sr (স্ট্রনশিয়াম), Ba (বেরিয়াম), Ra (রেডিয়াম)
  • কৌশল: বিরিয়ানি মোগলাই কাবাব রিয়ে বাটিতে রাখো।

p-ব্লক মৌল

➤ গ্রুপ ১৩: বোরন পরিবার (Boron Family)

  • মৌলসমূহ: B (বোরন), Al (অ্যালুমিনিয়াম), Ga (গ্যালিয়াম), In (ইন্ডিয়াম), Tl (থ্যালিয়াম)
  • কৌশল: বেগুন লু গ্যাজর লি। (থলি)

➤ গ্রুপ ১৪: কার্বন পরিবার (Carbon Family)

  • মৌলসমূহ: C (কার্বন), Si (সিলিকন), Ge (জার্মেনিয়াম), Sn (টিন), Pb (লেড)
  • কৌশল: কেমিস্ট্রি স্যাগেলে সোনা পাবে।

➤ গ্রুপ ১৫: নাইট্রোজেন পরিবার (Pnictogens)

  • মৌলসমূহ: N (নাইট্রোজেন), P (ফসফরাস), As (আর্সেনিক), Sb (অ্যান্টিমনি), Bi (বিসমাথ)
  • কৌশল ১: নাপ্রিয়া বই বিকার।

➤ গ্রুপ ১৬: অক্সিজেন পরিবার (Chalcogens)

  • মৌলসমূহ: O (অক্সিজেন), S (সালফার), Se (সেলেনিয়াম), Te (টেলুরিয়াম), Po (পোলোনিয়াম)
  • কৌশল: SSC তে ড়ে।

➤ গ্রুপ ১৭: হ্যালোজেন (Halogens)

  • মৌলসমূহ: F (ফ্লোরিন), Cl (ক্লোরিন), Br (ব্রোমিন), I (আয়োডিন), At (অ্যাস্টাটিন)
  • কৌশল: কির লিম ব্রাহ্মণকে ইবুড়ো খ্যা দিল। (F, Cl, Br, I, At)
  • বিকল্প কৌশল: টিকের লম ব্রজেন ন্সপেক্টরকে টকালো।

➤ গ্রুপ ১৮: নিষ্ক্রিয় গ্যাস (Noble Gases)

  • মৌলসমূহ: He (হিলিয়াম), Ne (নিয়ন), Ar (আর্গন), Kr (ক্রিপটন), Xe (জেনন), Rn (রেডন)
  • কৌশল: হে নাত, রিস না জেনন-ঙিন।

d-ব্লক মৌল (অবস্থান্তর মৌল)

➤ ৪র্থ পর্যায় (গ্রুপ ৩ থেকে ১২):

  • মৌলসমূহ: Sc (স্ক্যান্ডিয়াম), Ti (টাইটানিয়াম), V (ভ্যানাডিয়াম), Cr (ক্রোমিয়াম), Mn (ম্যাঙ্গানিজ), Fe (আয়রন), Co (কোবাল্ট), Ni (নিকেল), Cu (কপার), Zn (জিঙ্ক)
  • কৌশল: চীন টেন্ডুলকার ভেরি ক্রেজি ম্যান। ফেকোনিকাজিতবেনা?

এই কৌশলগুলো বারবার পড়লে এবং ছন্দের মতো করে মনে রাখলে পর্যায় সারণীর মূল গ্রুপগুলো আপনার সহজেই আয়ত্তে চলে আসবে।


উপসংহার

পর্যায় সারণী হলো রসায়নের ভাষা। এর প্রতিটি মৌল, তার অবস্থান এবং ধর্মের পরিবর্তন এক একটি গল্পের মতো। এই পোস্টের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করেছি সেই গল্পকে সহজ এবং বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে, যা আপনাকে একাডেমিক পড়াশোনা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সমানভাবে সাহায্য করবে। পর্যায় সারণীকে ভয় না পেয়ে, এর ভেতরের শৃঙ্খলা এবং সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করুন, রসায়ন আপনার কাছে অনেক সহজ হয়ে উঠবে।

Bigyanbook

লেখাটি কেমন কমেন্ট করে জানান। শেয়ার করুন এই পেজটি। পড়ুন অন্যান্য পোস্টগুলিও। youtube facebook whatsapp email

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন

Post Note

PDF